—- পরেশ কান্তি সাহা —-
তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তা সত্যিই অভাবনীয়। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাÐের সফলতার মধ্যে এটিও একটি। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দেশের সকল শ্রেণির শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন/প্রতিষ্ঠানসমূহের সার্বিক তথ্য সংগ্রহপূর্বক ডাটাবেজ তৈরি করার এক মহান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কারণ, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক শিল্পী ও সংগঠন/প্রতিষ্ঠান আছে যাঁরা অগোচরে, অবহেলায় কাটিয়ে যাচ্ছে তাঁদের সারাটি জীবন। করোনাকালে সরকারের এই মহতি উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারা যায় না।
ডাটাবেজ তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নির্ধারিত যে ফরম সরবরাহ করেছে, সেখানে সকল শ্রেণির শিল্পীদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, কোনো কবি-সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠনের কোনো তথ্য চাওয়া হয়নি। তারপরও জেলা শিল্পকলা একাডেমি যে ফরমগুলো কবি-সাহিত্যিকদের এবং সাহিত্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরবরাহ করেছে পূরণ করে জমা দেয়ার জন্য Ñ এটা নেহায়েতই তাদের অনুগ্রহ বা বদান্যতা।
ফরমে নাটক, সঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত, নৃত্য বিভাগ/উপবিভাগ উল্লেখ আছে আর যাত্রা, আবৃত্তি, কবিগান, মূকাভিনয়, যাদু, লাঠিখেলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য নির্মাণ, কারুশিল্প, চলচিত্র নির্মাণ, আলোকচিত্রশিল্পী বিভাগ/উপবিভাগকে হাতে লিখে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অথচ কবি-সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো তথ্য চাওয়া হয়নি।
তারপরেও কবি-সাহিত্যিক এবং সাহিত্য সংগঠনগুলো কাটাছেঁড়া বা হাতে লিখে ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছেন। এখানে প্রশ্ন জাগে- কবি-সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলো কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে? তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি হচ্ছে, অথচ এঁরা কি বাদ পড়বেন? এখন ঘরে বসে ক্লিক করলেই ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং দেশের যে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়। যেমন- জনসংখ্যা, স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গোরু, মোষ, ছাগল, হাঁস-মুরগি, বন্যপ্রাণি, হাতি, বাঘ, ইত্যাদির সকল তথ্যই মেলে। এমনকি অভয়ারণ্যে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ এবং বংশবিস্তারের জন্য সরকার ও পরিবেশবিদরা সকল প্রকার কার্যক্রম গ্রহণ করতে তৎপর। কেবলমাত্র তথ্য নেই কবি-সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলোর।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মাগুরা সদর মহোদয়ের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে জানতে পারি সাহিত্য সংগঠনগুলোর কোনো তথ্যই তাঁর কাছে নেই। বেশ কয়েকদিন আগে মাগুরা সাহিত্যিক কল্যাণ পরিষদের সম্পাদক কবি ও সাংবাদিক এম. এ. হাকিম এবং আমি জেলা প্রশাসক, মাগুরা মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ করলে তিনিও সাহিত্য সংগঠনগুলোর কোনো তথ্য দিতে পারেননি। যেখানে সংগঠনের তালিকা নেই, সেখানে কবি-সাহিত্যিকদের তথ্যের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সাহিত্য সংগঠনগুলোর নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থাও নেই। থাকলে অন্তত সংগঠনগুলোর একটা খতিয়ান পাওয়া যেতো। সমাজকল্যাণ বিভাগ নিবন্ধন দেয় শুধুমাত্র তাদেরই যারা কল্যাণমূলক কাজ করে। সাহিত্য সংগঠনগুলো তো আর কোনো কল্যাণমূলক কাজ করে না, যেকারণে তারা নিবন্ধিত হতে পারে না।
সত্যিকার অর্থে, কবি-সাহিত্যিক এবং সাহিত্য সংগঠনগুলো সবসময় অবহেলিত। হাইব্রিড ফসল ফলানোর জন্য প্রয়োজন উন্নত বীজ এবং নিবিড় পরিচর্যা। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের পরিচর্যার কোনো প্রয়োজন নেই। এঁদের চাল-চুলো বলতে কিছু নেই; সমাজের কিছু বিত্তবান এবং সহৃদয়বান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে। এমনকি শতকরা ৯৯টি সংগঠনের নিজস্ব অফিস আছে কি-না সন্দেহ। বছর দশেক আগে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সভাকক্ষে শুধু মাগুরার জন্য নয় সারা দেশের জেলা ও উপজেলায় সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করার প্রস্তাব করেছিলাম, যেখানে থাকবে প্রতিটি সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্য সংগঠনগুলোর জন্য অফিস, ছোট্ট একটা অডিটোরিয়াম এবং কমিউনিটি সেন্টার। ওই সভায় তৎকালীন মাগুরা পৌরসভার মেয়র জননেতা মরহুম আলতাফ হোসেন প্রস্তাবটি মাগুরার ভায়না মোড়ে বাস্তবায়নের সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবিক এর কোনো প্রয়োজন আছে কি?
আবার বড় বড় কথা বলতে শুনি কবি-সাহিত্যিকরা জাতির বিবেক। কথাটা কতটুকু সত্য তা নিয়েও সন্দেহ আছে। এঁরা কিছু দিতে পারে না সত্য, কিন্তু পথ দেখাতে তো পারে, প্রতিবাদ করতে পারে, কলমের কালি দিয়ে আগুন জ্বালাতে পারে, আগুন নেভাতেও পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু কি অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ হয়েছিল? কবিতা, গান, নাটক কি কোনো ভ‚মিকা রাখেনি? একসময় রাজদরবারে এঁরা বিশেষ আসন পেতো আর আজ কেন এই অবস্থা! মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আর মাত্র বাকি ছিল দুই দিন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা অনুধাবন করতে পেরেছিলো যে, তারা আর এখানে টিকতে পারবে না। যেকারণে ১৪ই ডিসেম্বরে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল বুদ্ধিজীবীদের। উদ্দেশ্য, জাতিকে বিবেকহীন বা অকার্যকর করা। অতীতের সেই শিক্ষা কি ভুলে গেছি? নিরবে কি চলছে ঘাতকদের সেই বিভীষিকাময় কর্মকাÐ?
সুকান্ত ভট্টাচার্য্যকে বলি, তুমি অপরিণত বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে চলে গেলে, অথচ মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছো- “এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”। কবি, অঙ্গীকার তুমি করেছ ঠিকই কিন্তু রাখতে পারোনি। ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পেলাম রক্তমাখা পতাকা, পেলাম একখানা জমিন। কিন্তু সেই জমিনে মিললো না খতিয়ান। কবি-সাহিত্যিকরাই রয়ে গেল খতিয়ানবিহীন, কী নির্মম পরিহাস !
লেখক- পরেশ কান্তি সাহা
মুক্তিযোদ্ধা ও সাহিত্যরত্ব
সভাপতি, গাঙচিল সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ
মাগুরা জেলা শাখা